নেশা জিনিসটাই তো খারাপ, আর তামাক সেই নেশার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এক অস্ত্র। কারণ, এটি শুধু ব্যবহারকারীর নয়, তার আশেপাশের মানুষদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ইতিহাসের পাতায় তামাক :-
ভারতে তামাকের ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগিজরা এটি ভারতে নিয়ে আসে। জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এক পর্যায়ে ডিক্রি জারি করে তামাক নিষিদ্ধ করেন। যদিও তার মৃত্যু হয় আফিম ও মদ্যপানের কারণে, তবু তার তামাকবিরোধী অবস্থান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
পরিসংখ্যান: চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো বাস্তবতা :-
আজ ভারতের ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যার ২৮.৬ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন। শহরাঞ্চলে এই হার ২১.২ শতাংশ, আর গ্রামাঞ্চলে ৩২.৫ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে ৪২.৪ শতাংশ আর নারীদের মধ্যে ১৪.২ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন।
১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৮.৫ শতাংশের তামাক ব্যবহারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভারত তামাক উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
সারা বিশ্বে ২২.৩ শতাংশ মানুষ তামাক ব্যবহার করেন—পুরুষদের মধ্যে ৩৬.৭ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৭.৮ শতাংশ। প্রতি বছর ৮০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তামাক; এর মধ্যে ১৩ লক্ষ মানুষ প্যাসিভ স্মোকিং-এর শিকার। ভারতে তামাকজনিত কারণে বছরে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৩.৫ লক্ষ।
| বছর | ধূমপান হার (%) | ধূমপানজনিত মৃত্যু (প্রায়) |
| 2020 | 27.2% | 1,000,000+ |
| 2021 | 10.7% | 1,048,266 |
| 2022 | 10.7% | 1,000,000+ |
| 2023 | 10.7% | 1,350,000 |
| 2024 | 10.7% (অনুমান) | 1,350,000 (অনুমান) |
| 2025 | 10.7% (অনুমান) | 1,350,000 (অনুমান) |
তামাকের রূপভেদ :-
তামাক ব্যবহারের দুটি প্রধান রূপ:
- ধূমপানযোগ্য তামাক: সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, পাইপ, হুকা, ই-সিগারেট ইত্যাদি।
- ধোঁয়াবিহীন তামাক: খৈনি, গুটখা, জর্দা, পানমশলা, গুল, নস্যি প্রভৃতি।
স্বাস্থ্যঝুঁকি :-
- ধূমপানকারীদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ৩১-৫৫% বেশি।
- ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০% বেশি।
- ক্যানসারের বড় কারণ: ফুসফুস, মুখ, গলা, পাকস্থলী, কিডনি, মূত্রথলি ইত্যাদির ক্যানসারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক।
- হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভাবস্থার সমস্যা সৃষ্টি করে।
- মুখের সমস্যা যেমন Periodontitis, Oral submucous fibrosis প্রভৃতি হয়।
- চোখের রোগ: CSCR, cataract, dry eye, diabetic retinopathy প্রভৃতি।
- স্নায়ুবিক রোগ, ডিমেনশিয়া এবং Green Tobacco Sickness নামে পরিচিত উপসর্গও দেখা যায় তামাক চাষীদের মধ্যে।
আইন ও প্রতিরোধ :-
ভারত সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে:
- COTPA, 2003: পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, বিজ্ঞাপন ও বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ।
- NTCP: National Tobacco Control Programme চালু।
- PECA, 2019: ই-সিগারেট নিষিদ্ধ।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ।
- প্যাকেটের উপর সচিত্র সতর্কতা বাধ্যতামূলক।
উপসংহার: মুক্তির পথ
তামাকের ব্যবহার শুধুমাত্র আইন দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়। চাই সচেতনতা, চাই মানসিক জোর। তামাক একপ্রকার মানসিক ও শারীরিক পরাধীনতা। জীবনকে ভালোবাসুন, বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করুন।
শ্বাস নিন মুক্তির। সুস্থ থাকুন।
সবার সেরা যে নেশা, তা হল জীবনের নেশা।
প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্নাবলি (FAQs)
তামাক কেন ক্ষতিকর?
তামাকের মধ্যে থাকে নিকোটিনসহ বহু বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যা ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, বন্ধ্যাত্ব ও চোখের রোগসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী অসুখের কারণ হতে পারে।
ধূমপান না করলেও কি তামাকের ক্ষতি হতে পারে?
হ্যাঁ, ধূমপায়ীর আশেপাশে থাকা মানুষজন প্যাসিভ স্মোকিং-এর শিকার হন, যা একই রকম ক্ষতিকর। প্যাসিভ স্মোকিং থেকেও ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রের অসুখ হতে পারে।
ধোঁয়াবিহীন তামাক (যেমন গুটখা, খৈনি) কি ধূমপানের চেয়ে নিরাপদ?
না, এইসব পণ্যও মুখ, গলা ও পাকস্থলীর ক্যানসারসহ বহু অসুখের কারণ হতে পারে। এগুলোর ক্ষতি ধূমপানের তুলনায় কম নয়।
তামাক ছাড়ার জন্য কী করা যেতে পারে?
মানসিক জোর, চিকিৎসকের পরামর্শ, নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (NRT), কাউন্সেলিং ও সচেতনতা বৃদ্ধি তামাক ছাড়তে সাহায্য করে।
তামাকের ব্যবহার বন্ধে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
ভারত সরকার COTPA আইন, PECA আইন, NTCP প্রোগ্রাম, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ, বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ এবং প্যাকেটে সচিত্র সতর্কতা ইত্যাদি ব্যবস্থা নিয়েছে।